শহীদি আত্মাদের যেন ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে (!) হ্যাঁ, অনুভূতিবোধ থেকে নিজের বিবেক যেন তাগিদ দিচ্ছিল সাধারণ জ্ঞানেই সেই কষ্টের কথা লিখতে। যে কষ্টের জন্য বাংলাদেশী বাঙ্গালী জাতির একজন এবং একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সত্যিই লজ্জিত ও দু:খিত। কেননা, শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ; শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বহুল প্রচারিত ‘স্বৈরাচার খ্যাত মাফিয়া চক্রের আওয়ামী দু:শাসনের পতন’- সেই সকল শহীদদের আত্মার প্রতি প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। যাঁরা নিজের বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েও অন্ধ হয়ে, পঙ্গু হয়ে, দু:খ কষ্টে বেঁচে আছেন, তাঁদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। এবার শহীদি আত্মদের কেন সংষ্কার ও নির্বাচন প্রসঙ্গে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে তা নিয়ে পাঠকের সাথে মত বিনিময়ের জন্য দুটো কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সাধারণ জ্ঞানের সোজাসাপ্টা কথায় শহীদি আত্মাদের ভাবনাতো শুরু হয়েছে ৮ আগস্ট থেকেই। যদিও ১৬ বছরের শাসন- শোষণ, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ, ভিন্নমত ও প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, উগ্রহিন্দুত্বাবদী-মৌলবাদী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তত্বাবধানে জনগণের অংশগ্রহন ছাড়াই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হওয়ার খায়েস পূরণে সম্প্রসারণবাদী ভারতের অনুগত রাষ্ট্র হিসেবে এক তরফা সুবিধা দিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জোট সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, ছোট ও বড় রাজনৈতিক দুলগুলোর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের অংশগ্রহনও শুরু হতে থাকে। কিন্তু চুড়ান্ত কর্মসূচি দিতে পারেনা এবং জনগণ প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে পারেনা। এমনি মুহুর্তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংষ্কার বলা হোক আর স্বৈরাচার পতনের কথা বল হোক, বৈষম্যবিরোধী শব্দ জনগণকে আস্বস্ত করে বৈষম্যের শিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবি-কর্মজীবি গরীব-সর্বহারা-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ছাত্র-যুবজনতাকে। তাঁরা জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, জীবন দেন আহত হন, পঙ্গু হন। গণজাগরণের এই পথে গণঅভ্যূত্থান ঘটে।
বিশ বছরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা যতই সময় যেথে থাকে ততই স্বৈরাচারের সকল বৈশিষ্টকে ‘আয়না ঘরে’ বন্দি করতে থাকে এবং এক পর্যায় স্বৈরাচার থেকে মাফিয়া চক্র প্রধান হন। ৫ আগস্টের সফল গণঅভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যান ভারতে। যদিও সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে গণঅভ্যূত্থানের আশঙ্কা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দলীয় কর্মীনির্ভর আন্দোলনে জনগণের তেমন অংশগ্রহন ছিল না। জনপ্রত্যাশা পূরণের অবশ্যম্ভাবাী সম্ভাবনায় রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ বন্দুকের নলের মুখে রাজপথে নেমে আসলে সফল গণঅভ্যূত্থান ঘটে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণের অর্পিত ক্ষমতাবলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সকলের ঐকমত্য ভিত্তিতে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। মাফিয়া প্রধান শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান মতে মনোনিত রাষ্ট্রপতির কাছে সেই সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণ করা হয়। ছাত্র যুব-জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই জনগণের রক্তপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার এবং নেতৃত্বদানকারী দল সমূহের সম্মতিতে শপথ গ্রহণ, তাতে জনগণের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়নি কি? তাদের মধ্যেই প্রশ্ন অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা নিয়ে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার যদি সংবিধান প্রণয়ন বা সার্বিক সংস্কার করতে পারেন জনগণের প্রত্যাশা পূলণের আশায় রক্তপথে গঠিত সরকার কেন পারবেন না?. যেহেতু গণঅভ্যূত্থানের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আন্দোলনে বৈষম্যমুক্ত সমাজের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রত্যাশী জনগণ। জনগণের প্রত্যাশার মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য এবং গণঅভ্যূত্থানের প্রত্যাশার বৈষম্যমুক্ত সামজের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংষ্কার হচ্ছে কি? না-কি শহীদদের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা শহীদদের রক্তস্রোতে ভাসছে ও ভাসতেই থাকবে? এমন প্রশ্নমূলক ভাবনা থেকেই শহীদি আত্মাদের যেন ভারতেও কষ্ট হচ্ছে (!) কোন সমাজ ব্যবস্থার রাষ্ট্র গড়ার সংষ্কার চলছে এবং নির্বাচন এগিয়ে আসছে এটাও তাদের ভাবাচ্ছে।
অনস্বীকার্য যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং চব্বিশের গণঅভ্যূত্থানে আত্মবলিদানকারী বীর শহীদদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষই শ্রমজীবি-কর্মজীবি, গরীব-সর্বহারা, বেকার, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ছাত্র-যুব জনতা। যারা অনেকেই তরুণ। অথচ তাদের প্রত্যাশার মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও গণঅভ্যূত্থানের ‘বৈষম্যমুক্ত সমাজ’। রাষ্ট্র সংষ্কারের যে কাজ চলছে এবং যে নির্বাচনের আয়োজন হচ্ছে, তাতে লক্ষ্য ও প্রত্যাশা যা-ই বলা হোক, আপত: দৃষ্টি তার সম্ভাবনা ক্ষীন। তদসত্বেও মানবাধিকার-বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সাম্য ন্যায় বিচার ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং কর্তৃত্ববাদী-স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পথ রুদ্ধ করতে, জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার আবশ্যক বলেও জনগণ মনে করেন। তাঁদের বিশ্বাস যারাই নির্বাচন করুন এবং সরকার গঠন করুন তারা হয়তো ভুলে যাবেন না ‘শহীদের রক্তেভেজা উর্বর মাটির ফসল খেয়ে জন্ম দেওয়া ও জন্ম নেওয়া ছাত্র-যুব-জনতা প্রয়োজনে আবারও রাজপথে নামবেন এবং লক্ষ্য অর্জনে ও প্রত্যাশা পূরনে এগিয়ে যাবেন শেষাবধি। বার বার রক্ত দিয়েছে প্রয়োজনে আবারো রক্ত দিবেন’। এটা ইতিহাসের স্বাক্ষ্য।
এবার দেখা যাক, ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে দেশে মোট ১২ (বারো) কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ভোটারের মধ্যে তরুণ ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি। তন্মধ্যে ১৮-২১ বয়সী ভোটার ৭১ লাখ ৯৯ হাজার ৭০৭ জন, ২২-২৫ বছরের ১ কোটি ১১ লাখ ৫৩ হাজার ১৮৩ জন এবং ২৬-২৯ বছর বয়সী ভোটার ১ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ০৮৩ জন। অনেকেই মনে করেন তরুণ ভোটারদের ভোট নির্বাচনে বিজয়ের ভিত্তি হতে পারে। যদিও সব দলেই তরুনের অংশগ্রহন রয়েছে। তন্মধ্যে নেতৃত্বসহ অংশগ্রহনকারীরা সবাই প্রায় তরুণ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তে। তবে মাথায় রাখতে হবে ডেঙ্গু, করোনা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নির্বাচনে বাধ সাধবে কি-না।
অপরদিকে উগ্রহিন্দুত্ববাদী মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে ও ‘র’- এর তত্বাবধানে অস্থিরতা সৃষ্টির পায়তারার আড়ালে রয়েছে অখণ্ড ভারতের নীল নকশা এবং ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেভেন সিস্টারসখ্যাত ৭ রাজ্যের ওপর কেন্দ্রিয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় গণবিরোধী ভূমিকাই যেন বলে ভারতের হারানো স্বর্গ (বাংলাদেশ) ফিরে পাওয়াসহহ নানামুখী অপতৎপরতার প্রভাব থাকছেই। এমনিতেই সীমান্তে পুশইন চলছে। এছাড়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের আধিপত্য বিস্তার ও বাজার দখলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধবিগ্রহের প্রভাব পড়তে আমাদের দেশ। পাশাপাশি আওয়ামীলীগের লুটেরা অর্থপাচারকারিরা অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিক- নেতাকর্মীদেরসহ তাদের জোটভুক্ত দোসরদের ষড়যন্ত্র-অপতৎপরতায় অস্থির পরিস্থিতির আশঙ্কাও রয়েছে। যা সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এছাড়া গণঅভ্যূত্থান ঘিরে রাজপথে যে ঐক্য ছিল, নিচর্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার লোভে পুঞ্জীভূত পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকেই দুরুত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, যা প্রয়োজনে জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও সংকট সৃষ্টি করতে পারে। তাইতো শহীদি আত্মাদেরও যেন ভাবতে কষ্ট হচ্ছে (!)
আরও পড়ুন- ঐতিহাসিক মুক্তাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার স্মরণে—

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী