হানাদার মুক্ত দিবস গাইবান্ধা ও মুক্তাঞ্চল রৌমারী। এবার নতুন আঙ্গিকে সামনে এসেছে দিবসটি। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এসেছিল মুক্তিযুদ্ধে আত্মবলিদানকারী বীর শহীদদের রক্তপথে। ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ এসেছে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রামের গণঅভ্যূত্থানের শহীদদের রক্তপথে। তাই প্রথমে সকল শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি এবং স্বজন হারানোদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
সেই সাথে স্মৃতির পাতায় হানাদার মুক্ত দিবস গাইবান্ধা ও রৌমারী মুক্তাঞ্চল নিয়ে ‘শিরোনাম’ ভিত্তিক লেখায় প্রথমেই শহীদদের আত্মার প্রতি অবনত মস্তকে এবং জাতির সামনে ব্যর্থতার গ্লানি হৃদয়ে চেপে রেখেই; আজকের দিন স্মরণে বলতে হচ্ছে-৫৩ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি গণতন্ত্রই যেন জনগণের কাছে ধরা দেয়নি। ফলে সাম্য, ন্যায়বিচার, মৌলিক অধিকারসহ বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং শোষণমুক্ত সমাজের ‘সাম্য’ হারিয়ে আকাশ-পাতাল ‘বৈষম্যের’ সমাজ ব্যবস্থায় (!) দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে মানুষ হচ্ছেন পিষ্ট। অস্থিরতা চারদিকে। তাই আজ হানাদার মুক্ত দিবসই যেন প্রশ্ন করছে, ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ কি অবশেষে বৃথা যাবে?
একজন মনিষীর কথা দিয়েই হানাদার মুক্ত দিবস গাইবান্ধা ও মুক্তাঞ্চল রৌমারী শীর্ষক আলোচনার এ পর্যায়ে তুলে ধরছি, মনিষী যা বলেছেন। মনিষী বলেছেন, ‘কোন ত্যাগই বৃথা যায় না’। দেশ, জাতি ও জনগণের শোষণ মুক্তি, পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি অর্থাৎ মহৎ উদ্দেশ্যে কোনো ত্যাগ বৃথা যায় না। তবে লক্ষ্য অর্জিত যদি না হয়। তাহলে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে, লক্ষ্য অর্জনে। আর লক্ষ্য অর্জিত হলে তা টিকিয়ে রেখে সামনের দিকে চলতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে ওঠে, বিশ্ব ব্যবস্থাজনিত কারণে।
যদিও ৫৩ বছরের বাস্তবতা বলছে-আমাদের দেশে লক্ষ্য অর্জনের পথে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন করতে হবে। যেমন লক্ষ্য অর্জন না হওয়ায় এবং বৈষম্য আকাশচুম্বী হওয়ায় আমাদের বীর সন্তানরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ব্যানারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে রাজপথে নামে। তাদের পরিচালিত আন্দোলনে-গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন হলেও ষড়যন্ত্র বা পাল্টা গণঅভ্যূত্থান সৃষ্টির অপতৎপরতা বিদ্যমান।
সেজন্য শহীদদের আত্মত্যাগের শিক্ষায় আত্মত্যাগে বলিয়ান হয়েই জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে প্রতিহত করতে হবে এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। ফিরে আসি হানাদার মুক্ত দিবস বিষয়ক প্রসঙ্গে। গাইবান্ধাসহ গোটা দেশকে হানাদারমুক্ত করার জীবন মরন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যাদের সার্বিক ভূমিকায় সফল মুক্তিযুদ্ধ, সেই বীর জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
পাঠক, ‘৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা হানাদার মুক্ত দিবস’ নিয়ে স্মৃতির পাতায় কি পেলাম তা প্রজন্মের অবগতির জন্য সংক্ষিপ্তভাবে একাধিকবার তুলে ধরেছি। সেই আলোকে এবারও তুলে ধরছি। একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর আর ২০২৪ এর ৭ ডিসেম্বর, মাঝে তেপ্পান্ন বছর। এই দীর্ঘ সময়ে রক্তার্জিত এই স্বাধীন দেশে রক্তের বিনিময়ে চাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি হৃদয় বিদারক এবং শুধু এই অধম সাধারন মুক্তিযোদ্ধা নয়, গোটা জাতিই বীর শহীদের রক্তের কাছে ঋণী। ৫৩ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্যের শোষনমুক্ত সমাজতো দুরের কথা, সত্যিকারার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি গণতন্ত্র। বরং গণতন্ত্রও যেমনি প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচন পদ্ধতি ও মানবাধিকার বিষয়ও প্রশ্নবিদ্ধ। উপরন্ত দ্রব্যমূল্য ও বৈদেশিক ঋণের ভারে জনগণ নাজুক অবস্থায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ঘুরে দাড়াচ্ছে। এমন সময়ে ৭ ডিসেম্বর আগত এবং ১৬ ডিসেম্বর আসছে। তাই শুধু যদি ৭ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত দিবসের একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে গবির্ত হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জনগণকে বলবো মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে। নয়তো শহীদদের রক্ত ঋণ থেকে জাতিকে মুক্ত করার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
সম্মানিত পাঠক, ৬ ডিসেম্বর ঊনিশশ একাত্তর। ভোর সাড়ে চারটা। বীরমুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মনছুর ও জহিরের নেতৃত্বাধীন আমাদের একটি টহল দল কোম্পানী হেড কোয়ার্টারে ফিরল। তিনটি টহল দল তখনও ফেরেনি। দু’চারজন মুক্তিযোদ্ধা সবেমাত্র ঘুমিয়ে পড়ছে। বাকী সবাই সশস্ত্র অবস্থায় জাগ্রত। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। টহল দল কি খবর নিয়ে আসে। এদিকে মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাড়াশি আক্রমণে হানাদারদের প্রত্যাহারের খবরে শহরতলীতে অবস্থান নেয়া হয়েছে। সকাল হলেই গাইবান্ধা জেলা (সেই দিনের মহকুমা) শহরে টহলের পালা। আনুষ্ঠানিকভাবে গাইবান্ধাকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করার সর্বশেষ ‘রেকি’ ।
শত্রুসেনারা ঘাপটি মেরে আছে কিনা তা যাচাই করতে। ইতিমধ্যে জেলার সাত থানার (উপজেলা) মধ্যে সুন্দরগঞ্জ ও ফুলছড়ি পুরোপুরি, গাইবান্ধা সদর ও সাঘাটার অংশ বিশেষ মুক্ত করে জেলা শহরে অবস্থান নিয়ে হানাদার মুক্ত জেলা (মহকুমা) ঘোষণার অপেক্ষায়। আপামর মুক্তিকামী মানুষের ৯ (নয়) মাসকাল নিষ্প্রাণ অবস্থায় জীবন-যাপনের অবসান প্রায়।
শহর ও শহরতলীর বাসাবাড়ী থেকে জনগণের কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের শহরে অনুপ্রবেশের আগেই কোন সময় যেন রাস্তায় জনতার ঢল নেমে পড়ে এমন অবস্থা। আমাদের ২ এমএফ কোম্পানীর অবস্থান জেলা শহরের কেন্দ্র (জিরো পয়েণ্ট) তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক কার্যালয় থেকে কয়েকশ গজ দুরে মডার্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫ ডিসেম্বর রাতে (পৌঁছি)। রঞ্জু কোং পুলবন্দি. পাশে খায়রুল কোং, লালু কোং ও সুজা কোং এবং ফুলছড়ি হয়ে সাঘাটার দিকে রোস্তম কোং। ফিরে আসা প্রথম টহল দল রিপোর্ট দিল সাদুল্যাপুর থানা হানাদারমুক্ত। মসজিদে ধ্বনিত হোল আযানের ধ্বনি।
গাইবান্ধা অঞ্চল ১১নং সাবসেক্টরের অধীন উইং কমান্ডার ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহ খান প্রথমে সাবসেক্টর (দায়িত্ব প্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার) কমান্ডার, পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের আহত হবার পর পুনরায় পুরো সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত কমান্ডার।
দ্বিতীয় টহল দল ফিরলো। এসময়ই সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান ওয়ারলেসে জানতে চান-শহর প্রটেকশনের ব্যবস্থা সম্পর্কে এবং টহল দলের রিপোর্ট । সকাল হয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে ও দেখতে ছোট ছোট দলে লোকজন আসছেন ক্যাম্পের দিকে। দ্বিতীয় টহল দলের রিপোর্ট মতে, পলাশবাড়ী থানা মুক্ত। তৃতীয় টহল দল আসেনি তখনও। তবে নৌবাহিনীর সদস্য আলী আজাদ ও ওয়াহেদুন্নবী মিন্টুর নেতৃত্বাধীন এটিম খালেদ দুলু বীর প্রতীক, শাহ শরিফুল ইসলাম বাবলু, সুফী সিদ্দিক, ফুল মিয়া, রঞ্জু, আবুল ও আলমগীরদের বিশেষ দল ফিরে শহর বিপদমুক্ত মর্মে রিপোর্ট পেশ।
নায়েক রেজাউল ও রকেট লাঞ্চারধারী লেঃ আব্দুল নায়েক মজিদের নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ টহল দল ফিরলো। সাথে সুজা মিয়া ও মমতাজ। গোবিন্দগঞ্জ থানা সদরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আর্টিলারী ট্রপসের অবস্থান রয়েছে মর্মে রিপোর্ট পেশ। এ সময় আমরা সবাই সশন্ত্র অবস্থায়ই। সেনা বিধি মতে কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আফতাব আলী (সুবেদার আলতাফ) বরাবরের মতই এই কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ও কোম্পানীর যুদ্ধের নীতি-কৌশল নির্ধারক উপদেষ্টা ও সকল সম্মুখযুদ্ধে নেতা হিসাবে স্মৃতির পাতা থেকে হানাদার মুক্ত দিবস নিয়ে লেখা- এই লেখকের কাছে সিদ্ধান্ত চান সেক্টর কমান্ডারকে রিপোর্ট করা প্রসঙ্গে। সেক্টর কমান্ডারের পূর্বসিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সম্মতিপোষণ করে, শহর প্রটেকশনের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে ‘ওকে’ রিপোর্ট পেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। তখনই ওয়ারলেস সেটে সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের রিপোটির্ং এর পর শহরের আনসার ক্যাম্পে আমাদের স্থানান্তর। সাব সেক্টর এডজুটেন্ট মিঃ শফিউল্লাহ ও কাজিউল ইসলাম, সাবসেক্টরের নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষক ইয়থ ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা আলী মাহবুব প্রধান (ক্যাপ্টেন মাহবুব) বিমান বাহিনীর আলতাফ উদ্দিন ও আনসারের আজিম উদ্দিন এবং অন্যান্যরা পৌছতেছে মর্মে খবর। শহর প্রোটেকশনে ২ এমএফ কোম্পানী কলেজ রোডের এতিমখানায় রেজাউল ও আঃ মজিদের নেতৃত্বে একটি দল।

শহরের উত্তর-পশ্চিম কোণে হাবিলদার মনসুর ও যুদ্ধাহত কালামের নেতৃত্বে একটি। পিটিআই ও এটিআই এলাকায় এমএন নবী লালুর লালু কোং ও আমিনুল ইসলাম সুজার সুজা কোং এবং রঞ্জু কোং এর জুবেল প্লাটুন। ২ এমএফ কোম্পানির সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে পূর্বাপর বিশেষ টহল দল কর্তব্যে নিয়োজিত। গোয়েন্দা কর্মকর্তা নূরুন্নবী বাবু ও ফজলুর রহমান রাজার দলও তৎপর। মফিজার রহমান খোকার কোং থাকবে সুন্দরগঞ্জ, আলম ফুলছড়িতে রোস্তম কোং’র রোস্তম ও গৌতম সাঘাটা, আজাদ, বাদল, মিন্টু, কাশেম চাঁদ, শওকত আলী, যুদ্ধাহত নুরুল আমিন হেডকোয়ার্টারে এবং টুকু ও মফিজ বোনারপাড়ায় থাকার সিদ্ধান্ত।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, ৬ ডিসেম্বর সকাল। নারী-পুরুষ ও ছেলেমেয়ে এক দু’করে রাস্তায় নেমে আসছে। জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানা সদরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি আর্টিলারী ট্রপস্ এর অবস্থানকে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত উল্লাস ও জোয়ার আমলে নিতে দেয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। আমরাও হানাদার বাহিনীর ক্ষয়িষ্ণু শক্তিকে গুরুত্ব দেইনি। আনন্দময় অবস্থার মাঝেই আমরা শহরের কেন্দ্রস্থলের আনসার ক্যাম্পে কোম্পানীর অবস্থান পরিবর্তন করি। সাথে প্রস্তুতি চলে ঐ নরপিশাচ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ট্রপসের উপর হামলার।
সেক্টর কমান্ডারের সাথে পরামর্শক্রমে আমাদের হেড কোয়ার্টার এটিইআই স্থানান্তর। সন্ধ্যার পর গোবিন্দগঞ্জে অবস্থানকারী হানাদার ট্রপসের উপর হামলার জন্য যাত্রা। লালু কোং অবস্থান নিবে পলাশবাড়ী। সুজা কোং ও রোস্তম কোং সহায়তা করবে আমাদের। ঘোড়াঘাট হয়ে মিত্রবাহিনী এবং ৭নং সেক্টরের দুলু গ্রুপ এগিয়ে আসছে বগুড়া হয়ে। এ সিদ্ধান্ত মতে আমার (লেখকের) সমন্বয়ে আক্রমণ দল এগিয়ে। আক্রমণ শুরু।
আক্রমণের তোড়ে দুটি আর্টিলারী গান ফেলে হানাদাররা দ্রুত পালিয়ে যায়। একজন হানাদার বাহিনীর নিহত। আমরা যখন আর্টিলারী গান দুটি দখলে নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানা সদরও মুক্ত মর্মে নিশ্চিত হলাম তখন ৭ ডিসেম্বর ভোর। জানামতে হানাদার মুক্ত নিশ্চিতকালের শত্রু সেনাদের কাছ থেকে ২এমএফ কোম্পানী কর্তৃক দখলকৃত আর্টিলারী গান দুটির একটি সেনা সদরে (সেনা যাদুঘরে) অপরটি জয়দেবপুর সেনানিবাসে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এ ভারী অস্ত্র দুটি হানাদার মুক্ত গাইবান্ধার সর্বশেষ নিদর্শন। জানামতে আর্টিলারী গান (দূরপাল্লার ভারী অস্ত্র) দুটিতে লেখা রয়েছে ২ এম এফ কোম্পানীর দখলকৃত, সুবেদার আফতাব আলী কমাণ্ডার। (কমাণ্ডার আফতাব আলী অনারারি ক্যাপ্টেন অব:) আফতাব আলী বীর উত্তম, বীর প্রতীক জানিয়েছেন, একটিতে এসকে মজিদ মুকুল (লেখক) নাম উল্লেখ করতে অনুরোধ করে দিলাম। কিন্তু সেনাবিধি মোতাবেক লেখা সম্ভব হয়নি।
৭ ডিসেম্বর সকাল। রাস্তায় নারী, পুরুষ ও ছেলে মেয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসছে। সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ মতে, মাহবুব এলাহী রঞ্জু বীর প্রতীক-এর নেতৃত্বাধীন রঞ্জু কোম্পানী শহরের পূর্ব পাশে পুলবন্দি থেকে জেলা শহরের ভিতরে প্রবেশের পালা। আমি চাইনিজ স্টেনগান ঘাড়ে সুবেদার আলতাফ (অনারারী ক্যাপ্টেন আফতাব আলী বীর উত্তম বীর প্রতীক) সহ শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগুলাম। জনতার ঢল নেমেছে শহরে। রঞ্জুকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছেন এক উৎসাহী মুক্তি পাগল মানুষ। শ্লোগানে মুখরিত শহর। বাড়ীতে যেন ফুলের গাছে ফুল নেই। ফুল ছিটাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। সেই ফুল রাস্তায় রাস্তায় জমাট বাঁধা শহীদের রক্তের উপর পড়ে যেন তৈরী হয়েছে ফুলের ডালা। এ দৃশ্য না দেখলে অনুভব করা যাবে না। বিভিন্ন দিকের গ্রাম থেকে হাজারো মানুষের মিছিল আসছে শহরের দিকে। শহরে চারদিকে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল দিয়ে বরণ করছে। সচেতন মহল কোম্পানী কমান্ডার ও সংগঠকদের ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করছেন।
উৎফুল্ল শুধু শহরবাসী নয়। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। যারা দলে দলে শহরে আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে, ফুল দিয়ে বরণ করতে ও কেউ কেউ দোয়া-আর্শীবাদ করতে। দেশের অবহেলিত উত্তর জনপদের এই সমস্যাবহুল গাইবান্ধা জেলা শহরটি ছোট হলেও সেদিন জনতার ঢল দেখে বোঝার উপায় ছিল না শহরটি ছোট। যেদিকে তাকানো গেছে সেদিকেই মানুষ।
স্বাধীনতা (সাবেক মহকুমা শিশুপার্ক) প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষের ভীড়। আর এই ভীড়ে শহীদ নজরুলের (মুক্তাঞ্চল রৌমারী কেন্দ্রিক যুদ্ধের শুরুতে প্রথম শহীদ) বাবা-মা খুঁজতে এসেছিলেন তাঁদের বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে। সাবেক মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার শাহজাদা ও মাজুদেরকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিতে এনেছিলেন যে বীর সংগঠক। সেই বীর সন্তানের খবর জানতে এক সময় শাহজাদাকে খুঁজতে থাকেন। শাহজাদা, মবিনুল হক (পরবর্তী প্রয়াত ইউনিট কমাণ্ডার) জুবেল ও ছানা প্রমুখ ছিল শহরে প্রথম অনুপ্রবেশকারী রঞ্জু কোম্পানীর একেকজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। জনতার উৎফুল্লতায় এক সময় ছেলেকে খোঁজা বাদ দিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নজরুলের গর্বিত ‘বাবা-মা’মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতে থাকেন। ‘তোমরা দীর্ঘজীবী হও’। তোমাদের ত্যাগ সার্থক হোক।
একইভাবে খুঁজতে আসে ২ এমএফ কোম্পানীর ঐতিহাসিক কোদালকাটির যুদ্ধে এসকে মজিদ মুকুলের নেতৃত্বে পরিচালিত সম্মুখযুদ্ধের ২য় বাংকারে থেকে বাদিয়া খালীর বীর শহীদ সামাদ ও আলতাফের বাবা-মা ও স্বজনরা এবং যুদ্ধরত বীর শহীদ নবীর হোসেনের বাবা। এ পরিস্থিতিতেই ঘোষিত হল সাত ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত গাইবান্ধা। প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। (পরবর্তীতে মাত্র দিবসটি ক’বছর ৯ ডিসেম্বর পালিত হতোÑ কেন পালিত হয়েছে তা অনেকের প্রশ্ন, অনুসন্ধানে বিষয়টি রহস্যাবৃত্ত)।
তবে পূনরায় আগের কথা পুনঃব্যক্ত না করে বিবেক যেন স্বস্তি পাচ্ছেনা। তাহলো অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা-লেখকদের কারো কাছে বা কারো লেখায় যেমন-চোখে পড়েনি, তেমনি কানেও শুনেনি ‘যে-গাইবান্ধা হানাদারমুক্ত করতে যে মুক্তাঞ্চলটি ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ও প্রবাসী সরকারের ৫টি বিভাগীয় কার্যক্রম চলেছে শেষাবধি এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে মুক্তাঞ্চলে পা রাখতে নৌপথ ও আকাশ পথে অনেকবার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। সেই মুক্তাঞ্চল নিয়ে তেমন কিছু শুনিনি ও জানিনি। হয়তো হতে পারে প্রতিবেদন লেখক ও গাইবান্ধার প্রথম পত্রিকা গণপ্রহরীর (বিধিমতে) প্রধান সম্পাদক রৌমারী মুক্তাঞ্চল ও প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলার প্রধান সংগঠক ও জেড ফোর্সের অধীন থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের স্বীকৃত বিশেষ ২ এমএফ কোম্পানীর মুক্তিযুদ্ধের নীতি-কৌশল নির্ধারক উপদেষ্টা ও সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নামটি লিখতে বা বলতে ইচ্ছুক নয় বলেই। যে কারণে নিজের ভিত্তির কথা বলেননি, সে কারণে সেদিনের বাস্তবতায় লেখাটি যদি কারো মনোকষ্টের বা ক্ষোভের কারণ হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে বিবেচনার অনুরোধ করছি, এখনও নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় ঔষধ নির্ভর চিকিৎসায় জীবনের শেষ মুহুর্তে।
তবে এবার হানাদার মুক্ত দিবস গাইবান্ধা ও রৌমারী মুক্তাঞ্চল শিরোনামের ঐতিহাসিক গুরুত্বের দাবিদার রৌমারী মুক্তাঞ্চল নিয় অতি সংক্ষেপে পাঠকের এবং রৌমারী মুক্তাঞ্চলকে ভিত্তি করে যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি মাত্র। উপরন্ত দীর্ঘ বিগত ৫৩ বছরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষা, খ্যাতি, অর্থ-সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি বলয়ে বর্তমান সমাজে উর্ধে স্থান করে নিজেদেরকে নিজেদের মতো করে তুলে ধরেছেন, যা প্রচার- প্রকাশনাও হয়েছে। সেক্ষেত্রে স্মৃতির পাতায় রয়েছে শুধুমাত্র নাম।
যেমন- আমার সংগঠিত কোম্পানীর সেনা সদস্যরা অনেকে সিপাহী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেনও হয়েছেন। অথচ তাদেরকে ওস্তাদ বলে সম্মোধন করা হতো আর তাদের বেশিরভাগই এই সংগঠক-সম্মুখযোদ্ধাকে লিডার বা নেতা বলে সম্মোধন করতেন। বিষয়টি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে বিবেচনার অনুরোধের সাথে প্রজন্মকে সজাগ হওয়ার আহবান জানিয়েই ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা হানাদারমুক্ত দিবস নিয়ে স্মৃতির পাতার কথাগুলো লিখছি। যে যুদ্ধের ভিত্তি ছিল রৌমারী কেন্দ্রিক মুক্তাঞ্চল। সেই মুক্তাঞ্চলের প্রায় সহস্রাধিক সংগঠক সম্মুখ মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা যোদ্ধারা যারা আজও স্বীকৃতি পাননি, অথচ আমি গর্বের স্মৃতিচারণ করছি।
তবে তাদের তালিকাভুক্তির জন্য নির্ধারিত ফরম জমাদানসহ আবেদন নিবেদনের কমতি নেই। এমনকি ২০১৬ সালের মার্চে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পতিত স্বৈরাচারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক, বিশেষ অতিথি হিসেবে অত্র লেখকের বক্তব্য প্রেক্ষিতে নিশ্চয়তা দিয়ে যা বলে এসেছেন। প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী এবং শেষাবধি নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে নৌ মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকাসহ খাদ্যসংগ্রহ ও চিকিৎসা সেবাদানসহ অর্পিত দায়িত যাঁরা পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে নৌ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ঢাকায় ফিরে দিবেন আর পর্যায়ক্রমে অন্যান্যদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা নেয়ার কথা দিয়েছিলেন বিরাট সমাবেশে। কিন্তু তারপর দীর্ঘ অর্ধযুগেও স্বীকৃতি পাননি বরং উপেক্ষিত হয়েছেন।

অথচ রৌমারী মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে যারা লেখকের সাথে ছিলেন তাদের মধ্যে কবি রাজ্জাক, আ: মান্নান, নরুজ্জমান, কিসমত আলী, মহিউদ্দিন, মতিউর রহমান মজনু, গাজী, কৃষক কর্মী রাজ্জাক, তাঁত শ্রমিক হারুন প্রমুখ। যাদের নাম না থাকলে রৌমারী মুক্তাঞ্চল ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যথাযথ হবে না। হয়তো তাদের ৭ তারিখ কিছুটা হলেও দুঃখ দিবে। সেজন্য আমিও দুঃখিত, বিজয়ে খুশি হলেও।
রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক লুৎফর রহমান এমএনএ, শাহ আঃ হামিদ এএনএ ডাঃ সোলেমান এমএনএ, সাদাকত হোসেন ছক্কু মিয়া এমএনএ, ভাষা সৈনিক এডভোকেট হাসান ইমাম টুলু, ভাষা সৈনিক মতিয়ার রহমান মতি মিয়া, আবু তালেব মিয়া এমপিএ, জামালুর রহমান এমপিএ, আজিজার রহমান এমপিএ, ওয়ালিউর রহমান রেজা এমপিএ, শামসুল হক এমপিএ, নুরুল ইসলাম পাপু মিয়া এমপিএ ও ডাঃ মফিজার রহমান এমপিএ প্রমুখ।
পাঠক, গাইবান্ধাসহ এক এক করে সকল জেলা হানাদার মুক্ত হতে হতে গোটা দেশ ও জাতি মুক্ত হয়েছে, বিনিময়ে ত্রিশ লাখ বীর শহীদের আত্মত্যাগ, আড়াই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম ও বীর জনগণের দামাল সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাজির মুক্তিযুদ্ধের বিজয় হয়েছে, হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু হানাদারমুক্ত দিবস নিয়ে লিখতে নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলেও একটি সত্য লিখতে হচ্ছে শহীদদের রক্তে ভেজা মাটির এই দেশে দীর্ঘ তেপ্পান্ন বছরেও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় শহীদদের আত্মত্যাগ বাস্তবায়িত হয়নি; যে কারণে জাতি বীরশহীদদের কাছে ঋণী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের (এবারের সংগ্রাম আমাদেও মুক্তির সংগ্রাম) মুক্তিও অর্জিত হয়নি। জানিনা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই লক্ষ্য অর্জনে ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন, শেষাবধি।
বরং পাকিস্তানী শাসক শোষক গোষ্ঠির শাসন- শোষন থেকে মুক্ত হলেও তার প্রভূ মার্কিনেরই নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী-পুজিবাদী, সম্প্রসারণবাদী শক্তি সমূহ এবং তাদের এদেশীয় দালাল আমলা-মুৎসদ্দী-পুঁজিবাদী, সামন্তবাদী বুর্জোয়া শাসক-শোষকদের উন্নয়নের জোয়ারে ভাসমান এই দেশে ‘মুক্তি’ শব্দটি যেন হারাতে বসেছে। একজন মনিষী বলেছেন, ‘একটি অগ্নিফ্লুলিঙ্গ বিরাট দাবানলের সৃষ্টি করতে পারে। ঠিক সেই মহামূল্যবান অমর বাণীর আলোকে প্রজন্মকে বলতে চাই, আমরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে একটি ভু-খন্ড একটি পতাকা দিয়েছি, তোমরা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে দেশী বিদেশী সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে সামন থেকে আরও সামনে। বিজয় তোমাদের নিশ্চিত। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।
[লেখক: রৌমারী কেন্দ্রিক যে মুক্তাঞ্চলকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারমুক্ত করেছে গাইবান্ধা, সেই মুক্তাঞ্চলের সংগঠক-ঘোষক ও প্রথম মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তাঞ্চল রক্ষায় নিয়োজিত থেকে ২ এম এফ কোং’র যুদ্ধের নীতি কৌশল নিধারক হয়ে সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক ও প্রধান সম্পাদক-প্রকাশক, সাপ্তাহিক গণপ্রহরী]

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী