Fri. Apr 25th, 2025
সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্যসিপাহী-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য

এসকে মজিদ মুকুল : সিপাহী জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য। তাৎপর্যপূর্ণ এই সিপাহী জনতার বিপ্লব সংঘঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। তার ৮২ দিন আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও বাকশাল চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হন, ধানমন্ডিস্থ নিজ বাসভবনে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার মূল নায়কদের সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও সরকার পরিচালনায় সহযোদ্ধা প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের ২৩ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদের ২১ জনকে নিয়ে সরকার পুনর্গঠন (একই মন্ত্রী পরিষদের সদস্য বলে পুনর্গঠন) করেন।

যাদের নেতৃত্বে সেনা অভ্যূত্থান ও খন্দকার মোশতাকের সরকার গঠন তাঁদেরকে মেনে নিতে পারেননি বাকশাল সমর্থক সেনাবহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম)। ১৫ আগস্টের অভ্যূত্থানকারিরা প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তাঁর অনুগত সেনাদের নিয়ে মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান ঘটান। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ রক্তপাতহীন অভ্যূত্থান ঘটাতে সেদিনের সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহামন (বীর উত্তম) কে আটক করেন। এবং তাঁরই নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী রাখেন। তাঁর নির্দেশে কাজটি করেন তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ। ঘটনার তাৎপর্যতা বিস্তৃত হতে থাকে। যে কারণে, জাতীয় জীবনে সিপাহী জনতার বিপ্লবের তাৎপর্য।

৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবসের তাৎপর্যতা উপলব্ধি করতে ‘যাকে দেখতে না-রি, তার চলন বাঁকা’- প্রবাদের পুনরাবৃত্তি করা ঠিক হবে না। জাতীয় জীবনে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের তাৎপর্য বিষয়ক আলোচনা সংক্ষিপ্ত হলেও বিষয়টি গুরুত্ববহ। অনস্বীকার্য যে, ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস, গুরুত্বপূর্ণ করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তম। যদিও পরবর্তীতে সামরিক আদালতে অনুষ্ঠিত বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা সেনানিবাস। চিন্তা-চেতনায় বা মতাদর্শ ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও পূর্বাপর সেনাজীবনে এবং মুক্তিযুদ্ধে জিয়া ও তাহের ছিলেন একান্ত ঘনিষ্ঠ। তবে বিচারে ফাঁসি হওয়ার পর বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে একটি রাজনৈতিক দল। ভারতপন্থী অন্যান্যরাও। সংক্ষিপ্ত আলোচনাটিকে বাংলাদেশ প্রীতি থেকে এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক দর্শনালোকে বিবেচনা করার অনুরোধও থাকছে, এই লেখার মাধ্যমে।

যদিও জানি, অতীত ছাড়া বর্তমান নয়, আর বর্তমান বাদ দিয়ে ভবিষ্যত নয়। আর ইতিহাসের সম্ভাব্য সঠিকতার জন্য চাই ভিন্ন মতেরও উপস্থিতি। সে দৃষ্টিকোন থেকে ‘নভেম্বর’ বৎসর গননার পরিক্রমায় একটি মাস। আর মাসের ত্রিশ দিনের প্রতিটি দিনই নভেম্বর মাসের। কিন্তু ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ শুধু নভেম্বরের নির্ধারিত তারিখ নয়। এই তারিখকে বলা হয় ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব দিবস অর্থাৎ বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি দিবস। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি, উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস- এমন বেশ কিছু দিবস আছে জাতীয় জীবনে গুরুত্ববহন করে। এমনি গুরুত্ববহনকারি ও তাৎপর্যপূর্ণ দিনই হচ্ছে ৭ নভেম্বর। সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা এ পর্যায়, যে কথাটি না বলে পারছিনা।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সামনে মাথা উচু করে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের কাছে অপরিসীম গুরুত্বের দেশ ‘বাংলাদেশ’। জীবনবাজির মুক্তিযুদ্ধের ফসল রক্তার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ। আর সেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বাদানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বীকৃত দুই কৃতি সন্তান জিয়াউর রহমান এবং আবু তাহের। কেননা, দুজনেরই রয়েছে অত্যন্ত গৌরবজ্জল ভূমিকা। একজন একাত্তরের ২৬ মার্চ সেনাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মাচর্ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তিনি সেদিনের মেজর জিয়াউর রহমান। আরেকজন মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত ১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক ও সম্মুখ যুদ্ধে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহের। মতপার্থক্য বলি আর আদর্শগত পার্থক্যই বলি অথবা মত ও পথ ভিন্ন বলি। ঠিক তাই, তাঁদের চলার পথও হলো ভিন্ন। জিয়া সেনাবহিনীতে থেকে যান আর আবু তাহের ৭২ সালে অবসর নিয়ে গিয়ে জাসদের গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন।

তবে হ্যাঁ, সাধারণ দৃষ্টিতে রাজনৈতিক ভাবধারায় বা চেতনায় দু’জনের পথ ছিল ভিন্ন। জিয়া ছিলেন জাতীয়তাবাদী। সেই আলোকে হৃদয়ে লালিত উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত জনগণকে সামাজিক শক্তিতে পরিণত করা। আর এই সামাজিক শক্তির পাশাপাশি সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলোকে গণমুখী করা। যাতে তারা সচেতন জনগণের মাধ্যমে (মিডিয়া) পরিণত হন। এই সম্মিলিত সচেতন জনগণ ও শক্তিগুলোর উপর নির্ভর করে বিশ্ব সভায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতি অত্যন্ত মজবুত ও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল জিয়ার। তারই বহিঃপ্রকাশ বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্যে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

পক্ষান্তরে, কর্ণেল তাহের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশকে সঠিক ধরে নিয়ে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র হিসেবে যেমনি চিহ্নিত করতেন। তেমনি মনে করতেন জনকল্যানের জন্য বুর্জোয়া গণতন্ত্র অর্থহীন। কর্ণেল তাহের আন্তার্জাতিক সামজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি মার্ক্সীয় দর্শনালোকে পুরনো সামরিক বাহিনীকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে গুড়িয়ে দেয়াকে আবশ্যকীয় করণীয় মনে করতেন। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের নতুন সমাজের জন্য উপযোগী করে নতুন সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার বিশ্বাসী ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের।

এদিকে সামরিক বাহিনীর স্বরূপ ও ভূমিকা কি হবে, তা নিয়ে জিয়ার চাওয়া, কর্ণেল আবু তাহেরের চাওয়া ও বিশ্বাসের সাথে মিল ছিল না। জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনী হবে, অতন্দ্র প্রহরী। সেই বাহিনী পেশাদারিত্ব ভূমিকা পালনকারী বহিনী হবে রাষ্ট্রের, বিশ্বস্ত ও জনগণের আস্থার প্রতিক। এই যে, আদর্শিকভাবে চিন্তাভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একজন সমাজতন্ত্রী আরেকজন গণতন্ত্রীয়। এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যই ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরী করেছে। যদিও পাকিস্তান সেনাবহিনীতে দায়িত্বপালনকালে এবং মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নেতৃত্বদানে ছিলো দু’জনের ঐকমত্য ও প্রয়োজনে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতেন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা হিসেবেই।

এতক্ষণের আলোচনায় আমরা সুনিশ্চিত হলাম দু’পথে দু’জন। তবে সিপাহী জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য বলছে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দু’জনের মধ্যেকার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট ছিল। তাইতো ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘঠিত অভ্যূত্থানে জিয়াকে আটক করেন। এবং তারই নিজ বাসভবনে বন্দী করে রাখে। ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ বাসভবনটির টেলিফোনে লাইন বিচ্ছিন্ন করলেও অসাবধনতা বশত: জিয়াউর রহমানের বেডরুমের লাইনটি বিচ্ছিন্ন হয়নি।

জিয়াউর রহমান একটু সময় লাগলেও বেডরুমে ঢুকে কর্ণেল তাহেরকে ফোন করে তাকে রক্ষা করতে বলতে পেরেছিলেন। সূত্রমতে, বলেছিলেন ‘সেভ মাই লাইভ’। কর্ণেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় অবস্থান করছিলেন। খবরটি জানার পর, ঢাকাতে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে থাকা তাঁর অনুগত ও তাঁর উদ্যোগে গঠিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার নিদের্শ দেন। এবং জাসদ কর্মীদের সাথে নিয়ে ঢাকায় উপস্থিত হন।

কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যূত্থান। কর্ণেল তাহের অভ্যূত্থানকারীদের সাথে নিয়ে জিয়াউর রহমানকে তাঁর বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। মতভেদে সিপাহী জনতা নিয়ে আসেন। সিদ্ধান্ত ছিল জাসদ কার্যালয় ঘিরে অনুষ্ঠিতব্য সিপাহী জনতার সমাবেশে দুই বীর সন্তান জিয়াউর রহমান ও আবু তাহের বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু উর্ধ্বতন জুনিয়র সামরিক অফিসারদের পরামর্শে জিয়া ভাষন দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি সেনানিবাস থেকে বের হতেও রাজি হননি।

কৌশলী যুদ্ধের জন্য তীক্ষè বুদ্ধিমান কর্ণেল তাহের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। কর্ণেল তাহের পাল্টা অভ্যূত্থানের চেষ্টার কারণে গ্রেফতার হন। অনেক জাসদ কর্মীও গ্রেফতার হন। এবং সেনা বিচারে ২১ নভেম্বর তাঁর ফাঁসি হয়। যে বিচারকে প্রহসনের বিচার ও ৭ নভেম্বর বিপ্লবের কারিগর আখ্যায়িত তাহেরের স্থলে ক্ষমতায় বসেন জিয়া। এই বিভ্রান্তি থেকে আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্লেষণ করতে আবারো মুক্তিযুদ্ধের এই বীর অগ্রণী সেনানায়কদের কৃতিত্বকে ইতিহাসে যথযথ সম্মানে ভূষিত করে রাখতে হবে।

আর তা করতে হলে আবারো দু’জনের দু’পথ আলোচনায় আনতে হবে। এবং আনতে হবে ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যূত্থানের নায়ক কে ফোর্স অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের ভূমিকাও। এক্ষেত্রে প্রথমেই বিবেচনায় নিতে হবে ১৫ আগস্টের ক’জন মধ্যম সাবিরর সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বের অভ্যূত্থানকে। এবং রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া। হত্যাকাণ্ড যতই নির্মম হোক জনগণ স্বাগত জানিয়েছে সেই অভ্যূত্থানকে। কারণ বঙ্গবন্ধু সারা জীবন যে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, সেই গণতন্ত্রকে একদলীয় শাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে ধ্বংস করেছেন। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েতের ন্যায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অবাস্তব চিন্তা এবং সম্প্রসারণবাদী ভারতের কর্তৃত্ব জনগণ মেনে নেননি। উপরন্তু ভারতীয় বাহিনীর আদলে ও অধিনায়কত্বে গঠিত রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-গুম এবং আওয়ামীলীগের বিভিন্ন নামের বাহিনীর অনাচার-বেবিচার-জুলুম-অত্যাচার; লুটপাট ও অরাজকতা সৃষ্টিতে, মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়কালে দেশপ্রেমিক বাম প্রগতিশীল বিপ্লবীদের এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উজ্জীবিত ছাত্রযুবক এবং জাসদের গণবাহিনীর ত্যাগী সদস্যদের, ৩৪ হাজারের অধিক হত্যা করা হয়। যা ৭ মার্চ বিপ্লবকে তরাণি¦ত করে। উপরন্তু বিদেশি থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রী ও সাহায্যের অর্থ লুটপাটের ফলে ‘৭৪ সালের চরম দুর্ভিক্ষ মুজিব সরকারের পতনের প্রধান কারণ। এই পরিস্থিতিতে খালেদ মোশাররফের গণঅভ্যূত্থান দেশপ্রেমিক সেনারা মেনে নিতে পারেননি। কর্ণেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে প্রচারিত লিফলেটে খালেদ মোশাররফকে ভারতপন্থী আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তাই ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের দিনই অভ্যূত্থানের সেনারা বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে। তিনি নিজেই সিপাহী জনতার আকাঙ্খা এবং দেশ প্রেমিকতার বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান করেছিলেন। তাই তার করুণ পরিণতি তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে লেখা থাকবে। এর মধ্যে দিয়েও ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব জাতীয় জীবনে তাৎপর্য’-প্রকাশ পায়।

সিপাহী জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য নিয়ে কথা বলতে আবারো ফিরে আসতে হয় কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তমমের কথায়। যাঁর মহৎ উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের শোষণমুক্ত সমাজের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যেই চীন বিপ্লবের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর শিক্ষায় শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভিত্তি ধরে নিয়েছিলেন। এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আণ্ডারগ্রাউন্ড শাখা সশস্ত্র গণবাহিনীর কমাণ্ডার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সরকারকে পরাজিত করে বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। তাই তার এ উদ্দেশ্যকে অবশ্যই মহৎ বলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কোন ভিত্তিতে এত সহজে এতটা আশান্বিত হয়েছিলেন এবং বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল- এটা আগের অংশে আলোচনা হয়েছে। তদসত্বেও বিভ্রান্ত দূরীকরণে একটু আলোকপাত করা দরকার।

সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য

সেনাবাহিনীতে তার প্রভাব থাকায় প্রতিরক্ষাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট গঠন করেছিলেন। সে সব গঠিত হয়েছিল তাঁরই নির্দেশে। উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য যেমন তাঁর নির্ভরশীল শক্তি ছিল। তেমনি ছিল ত্যাগী শিক্ষিত সচেতন গণবাহিনীর সদস্য ও দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তৃতীয়ত: প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে নানা মতভেদে বিশেষত: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও নতুনভাবে যোগদানকারীদের সাথে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকা। এতে করে সংখ্যানুপাতে তার অনুগত সেনাসদস্য ও গণবাহিনীর সদস্য সংখ্যাসহ মোটামুটি সন্তষজনক বলে ধরে নিয়েছিলেন। চতুর্থ, বাকশাল সরকারের শাসন শোষণ অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-গুম, জেল-জুলুম এবং দারুণ অভাবে হাড্ডিসার মানুষসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষ ছিলেন সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। এমন আরো বেশ কিছু দিক ছিল। যে সব ভিত্তিতে তিনি ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। যা, সিপাহী জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য বিশ্লেষণে বিবেচ্য।

কিন্তু ১১নং সেক্টরের ময়মনসিংহের তাৎপর্যপূর্ণ সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অধিনায়ক কর্ণেল তাহেরের প্রতি সম্মান রেখেই, বলতে চাই তিনি যত সহজভাবে হিসাব মিলিয়েছেন। হিসাবটা অত সহজ নয়। কেননা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছিল দেশের ৭ কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশ গ্রহন। আর জাসদ ও গণবাহিনীকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আতঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করতেন। এমনকি মায়েরা শিশু সন্তানদের ঘুম পাড়াতে ভয় দেখাতেন। ঘুমাও, জাসদ আসতেছে। জাসদের কথা শুনলে শিশুরাও যেন কান্না বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তো।

তাছাড়া তিনি যে সামরিক বাহিনী বদলাতে চেয়েছিলেন, সেই বাহিনীর যুদ্ধের ছকে বিপ্লব করা যায় না। যদিও তিনি রুশ বিপ্লবের আগের সোভিয়েতের আদলে চিন্তা করেছিলেন। যা ঠিক হয়নি। কেননা রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ অংকের চেয়েও কঠিন। বরং মাও সেতুং এর বই পড়ে তার কোটেশন ব্যবহারের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া উচিত ছিল। এবং চীনের কৃষি বিপ্লবের শিক্ষাগ্রহন করা বাঞ্চনীয় ছিল।

তিনি (কর্ণেল তাহের) জানতেন এবং দেশের মানুষও জানতেন শতরা ৮৫ জন মানুষ কৃষক। আর কৃষককে মুক্ত করতে কৃষক জনগণের উপর নির্ভরশীল হওয়া প্রথম জরুরী কাজ। কারণ সেনা সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ৮৫ জন কৃষকের সন্তান এবং তারাই মুক্তিযুদ্ধকেও সফল করেছেন। চীনের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং বলেছেন, ‘বিপ্লবী যুদ্ধ হচ্ছে ব্যাপক জনগণনের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ একমাত্র উপায়ে করা যায় ব্যাপক জনগণকে সামিল করে এবং তাদের উপর নির্ভর করে’। তা না করায় তার নেতৃত্বের সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরাই তাকে গ্রেফতার করেছেন এবং সামরিক আদালতের বিচারে ফাঁসি হয়েছে। কারণ সেনা সদস্য স্ব স্ব পরিবারের কাছে এবং এলাকায় জেনেছেন জাসদের পক্ষে জনসমর্থন নেই। অথচ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, এটা অনস্বীকার্য। একইভাবে অনস্বীকার্য যে তিনি ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের জিয়ার উপরই নির্ভরশীল ছিলেন তাঁর ত্যাগ-ভূমিকা জনসমর্থন ভিত্তিতে।

‘৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব ও জাতীয় জীবনে তাৎপর্য’ নিয়ে লিখতে ইতিহাসের একটি অধ্যায় লিখতে হবে। তা আজকের বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে সংক্ষেপ লেখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই লেখার এ পর্যায় প্রথমেই আমি জেড ফোর্সের একজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অধিনায়ক জিয়ার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাঁকে নিয়ে লিখতে নিজের ঘোষিত ও সংগঠিত রৌমারী মুক্তাঞ্চলের ঐতিহাসিক কোদলকাটির সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধা হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালে; তিনি (জিয়া) কোম্পানী কমাণ্ডারের সাথে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন তা লিখতে হবে। যা এ মূহুর্তে নয়। তবে চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমার চাওয়া মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন নয়। তেমনি চলতি চব্বিশের ৫ আগস্টের গণঅভূত্থানের চাওয়া বৈষম্যহীন সমাজের রাষ্ট্র ব্যবস্থাও নয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত সকল শহীদের আত্মত্যাগকে স্বার্থক করতে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের সমাজ ব্যবস্থা অপরিহার্য বলে মনে করি। জেড ফোর্স অধিনায়ক এবং ২৬ মার্চ ১৯৭১-এ স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান নেই। তাই বলার নেই। শুধু বলবো ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের অংশগ্রহনকারীরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষককে রক্তার্জিত এই স্বাধীন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অভিনন্দন-তাঁদের সকলের প্রতি।

সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই শুরু হয় রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে পথ চলা। দেশবাসী জানেন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত না হলেও; আপাত দৃষ্টিতে বলা যায়, ৭ নভেম্বর দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র থেকে অনির্ধারিত সময়ের জন্য হলেও মুক্তি পেয়েছিলো দেশ ও জাতি।

শেষ করার আগে উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথমপক্ষে দুটি বড় অভ্যূত্থানসহ একাধিক অভ্যূত্থানের চেষ্টা হয়। এতে মাসটি ছিল যেন উত্তাল। এমনকি সেনানিবাসের মধ্যে একের পর ঘটনাও ঘটছিল অল্প সময়ের ব্যবধানে। অভ্যূত্থানে অংশগ্রহণকারীদের পাল্টা অভ্যূত্থানের চেষ্টা হচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে অনাকাঙ্খিত হলেও মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাসহ অনেক সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। সেনানিবাসে যেন শৃঙ্খলা লোপ পাচ্ছিল। এমনিতর পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বদানে ও জনপ্রিয়তায় সেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সিপাহী-জনতার অর্পিত দায়িত্বে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় দেশবাসী হারিয়েছিলেন আশ্বস্ত। জুনিয়ার অফিসার ও সৈনিকদের সাথে মানুষ একসাথে নেমে এসে যেন বিজয় উল্লাস করেছেন। তিনি খুবই সাধারণ আন্তরিক ও বিশ্বতার স্বাক্ষ্য রেখেছেন রেডিওতে দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে। সবমিলে ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব ছিল জাতীয় জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ।

By SK Mazid Mukul

প্রধান সম্পাদক, গণপ্রহরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *